ওয়েব ডেস্ক: এবার অস্বাভাবিক বর্ষা মৌসুম চলছে। আষাঢ়-শ্রাবণে বর্ষার ভরা মৌসুমেও দেখা মিলছে না বৃষ্টির। তাপমাত্রা থাকছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। জুলাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। আগস্টেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
দুদিন পর শেষ হচ্ছে শ্রাবণ। কাগজে-কলমে শেষ হবে বর্ষাকালও। তবে আবহাওয়ার হিসাবে বর্ষাকাল থাকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপরই দেশ থেকে বিদায় নেয় বর্ষার বৃষ্টি ঝরানো দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু।
বর্ষার বাকি সময়টাও কী এভাবে অস্বাভাবিকতায় কাটবে- এমন প্রশ্নের জবাবে আবহাওয়াবিদরা ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাকি সময়েও বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। বিচ্ছিন্নভাবে কিছুটা বৃষ্টি হতে পারে। তবে টানা বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এবার কিছুটা আগে গত ৩১ মে (১৭ জ্যৈষ্ঠ) দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূলে এসে পৌঁছায়। এরপর কিছুটা বৃষ্টি ঝরালেও মধ্য আষাঢ়ের পর মৌসুমি বায়ু অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এখনো সেই অবস্থায়ই আছে।
দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে দেখা গেছে, একটু মেঘ জমে খানিক সময় বৃষ্টি ঝরছে। এরপর আবার রোদ। ভ্যাপসা গরমের কষ্ট।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জুলাই মাসের পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, জুলাইয়ে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃষ্টি কম হয়েছে। ওই মাসে তাপপ্রবাহ ছিল ১৮ দিন।
জুলাইয়ে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ।
দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দিতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি আগস্টের পূর্বাভাসে এরই মধ্যে জানিয়েছে, আগস্টে সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। এ মাসে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে মৃদু (৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
চলতি আগস্ট মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে এরই মধ্যে বলেছি, আগস্টে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু কম বৃষ্টি হবে। স্বাভাবিকভাবে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বর্ষা বাংলাদেশ থেকে চলে যায়। কখনো কখনো দেরি হয়, বর্ষা যেতে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত লেগে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এবার শুধু বাংলাদেশের বর্ষাকালই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। ফ্রান্সে ৬৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। সারা বিশ্বেই একটা জলবায়ুজনিত পরিবর্তন ঘটেছে। সেখানে বাংলাদেশেও এর ছোঁয়া লেগেছে। এবার বর্ষাকালের চরিত্রে অস্বাভাবিক চরিত্র বিরাজমান।’
এ আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, ‘এর মধ্যে হয়তো বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ তৈরি হতে পারে। তখন হয়তো বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি একটু বাড়বে। তবে খুব বেশি যে বৃষ্টি হবে, এমন নয়।’
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, ‘এখন তো আবহাওয়ার কোনো সিস্টেমই ঠিক নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর আবহাওয়ায়ই পরিবর্তন এসেছে। এতে কোনো স্থানের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রার সঙ্গে আবহাওয়ার যে কোনো সিস্টেমের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।’
বাংলাদেশের আবহাওয়া বঙ্গোপসাগর ও হিমালয় পর্বতমালার ওপর নির্ভরশীল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পশ্চিম থেকে যে বাতাসটা (ওয়েস্টারলি) আসে, সেটা যদি শক্তিশালী হয় তখন বঙ্গোপসাগর থেকে দক্ষিণা বাতাসটা ওপরে উঠতে পারে না। যার জন্য মেঘ সৃষ্টি হওয়ার মতো পর্যাপ্ত জলীয়বাষ্প পাওয়া যায় না। এতে বৃষ্টিপাত কমে যায়। আমাদের এখানে বৃষ্টি কম হওয়ার এটাই কারণ।’
‘সামনে হয়তো কিছুটা বৃষ্টি হতে পারে। তবে তা স্বাভাবিকের মতো হবে না। তবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তুলনামূলক কিছুটা বেশি বৃষ্টি থাকতে পারে’ বলেও উল্লেখ করেন এ আবহাওয়াবিদ।
শাহ আলম বলেন, ‘অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ষা থাকার কথা। তবে আমরা দেখেছি, সেপ্টেম্বরে মিক্সড সিস্টেম চলে আসে। তখন আমরা কুয়াশাও পড়তে দেখি। সেপ্টেম্বরে শেষরাতে শিশিরও পড়ে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক এ পরিচালক আরও বলেন, ‘আবহাওয়া এখন আর প্রথাগতভাবে বর্ষাকালে আসবে কিংবা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতেই আমাদেরও খাপ খাইয়ে নিতে হবে। দেখা যাবে বৃষ্টি নেই, আবার একদিন বৃষ্টি হয়ে সব তলিয়ে যাচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে আমাদের ফসল উৎপাদন করতে হবে। তা না হলে আবহাওয়ার অস্বাভাবিকতা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাবে ফেলবে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট উত্তরাঞ্চলে তাপপ্রবাহ শুরু হয়। একদিন বিরতি দিয়ে ৭ আগস্ট থেকে ফের শুরু হয় তাপপ্রবাহ। পরে সেটাও দূর হয়ে যায়।
গত ১১ আগস্ট উড়িষ্যা উপকূলের অদূরবর্তী উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীসময়ে এটি স্থল নিম্নচাপ হিসেবে বৃষ্টি ঝরিয়ে ভারতীয় এলাকায় নিঃশেষ হয়ে যায়। এর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কিছুটা বৃষ্টি হয়। দেশের অন্যান্য অংশে তেমন বৃষ্টি ছিল না।
এখন দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকছে বলেও জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।